আপনারা এত ভালোবেসে আমার লেখা পড়েন, ছাইপাঁশ যা লিখি প্রশংসা করেন, যে মনে হয় কি ছেড়ে কি আগে লিখি। ইচ্ছে করছে একসাথে এতগুলো বছর আপনাদের বলে ফেলি। কিন্তু কত আর টাইপ করা যায় ! তাই লেখার চলন আর গতি একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজগুণে মাফ করে দেবেন আশা রাখি।
কুয়েতে কিন্তু বিদেশীরা একচেটিয়া বাসিন্দা হতে পারেনা। যদ্দিন কাজ, তদ্দিন থাকা। অকুয়েতি তাবড় বড়োলোকও টাকার জোরে এদেশে জমি বাড়ি কিনে গেঁড়ে বসতে পারবেনা। তাছাড়া রাজধানী কুয়েত সিটির একটা বড়ো অঞ্চলে শুধু কুয়েতিরাই বাস করে। সেখানে বিদেশীরা ভাড়াও থাকতে পারবেনা।
কুয়েতিরা থাকে বিশাল বিশাল বাড়িতে ; অট্টালিকা সম। বিভিন্ন এলাকায় তাদের আবার দুদশটা করে দশ বারো তলা ফ্ল্যাট আছে। সেগুলোকে এরা ক্যাম্প বলে। সেই ক্যাম্পে গরীব দেশের গরীব মানুষরা একেকটা ঘরে ডর্মেটারি সিস্টেমে থাকেন। আটদশজন মিলে একটা রান্নাঘর ও একটা বাথরুম শেয়ার করেন। সুরোজগেরেরা এমন ক্যাম্পেরই একটা পুরো ফ্ল্যাট নিয়ে বা সমুদ্রের ধারের ছোট ভিলা ভাড়া করে থাকেন।
এদের টাকা আছে, আমাদের আছে কায়িক এবং মানসিক মেধা। পড়াশোনার বহর এখানে অতি দুর্বল। সাধারণতঃ স্কুল পাশ করেই কুয়েতি ছেলেপুলেরা আমেরিকায় পড়তে চলে যায়। ডিগ্রি হাসিল করে এসেই কোন একটা তেল কোম্পানি বা ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতে ট্রেনি হয়ে ঢুকে পড়ে। তারপর রক্তসূত্রে তড়তড়িয়ে বসেরও বস। এসব নিয়ে দুঃখ করলে চলবেনা। আমাদের আছে ইউনিয়ন, এদের আছে ইউনিটি। পয়সা বানাতে এসব দেশে আসা বাপু। তাই কাজ করো পয়সা নাও আর নিজের দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবসায় সাহায্য করে নিজেও লাভবান হও।
মোটামুটি বড়োসড়ো পদে থাকলে সাধারণতঃ বঞ্চিত হবার ভয় নেই। বরং ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময় কাজ, ওভার টাইম হলে একদিনের মাইনে, ভালো কাজ করে কোম্পানির লাভ করালে অর্থমূল্যে পুরস্কার ইত্যাদি ভালোই ব্যবস্থা। কিন্তু স্বল্পশিক্ষিত বা অক্ষরপরিচয়হীন মানুষ মানে বাড়ির কাজের মেয়ে, লেবার কি ড্ৰাইভার এঁদের কর্মজীবন সবসময় কিন্তু মসৃণ হয়না। অনেকাংশেই মালিকের স্বভাব এবং মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীল।
এক পাকিস্তানী পরিচারিকার মুখে জেনেছিলাম আগে তিনি এক কুয়েতি বাড়িতে সবসময়ের জন্য বহাল ছিলেন। বাবা মা দু তিনটে ছেলে বউ ছ সাতটা নাতি নাতনী নিয়ে বড়ো সংসারের সমস্ত কাজ করেও বিশ্রামের বদলে জুটত অকথ্য বকুনি আর লাঞ্ছনা।এঁদের পাসপোর্ট মালিকের কাছে জমা থাকে বলে ইচ্ছেমত দেশে ফিরে যাবারও উপায় থাকেনা। সংশ্লিষ্ট দেশের এম্ব্যাসির সাহায্য পেলে তবেই কিছু হতে পারে।
একবার একজন বাংলাদেশী ড্রাইভার দুঃখ করেছিলেন পাঁচ বছর ধরে ছুটি পাননি। দেশ ছেড়ে আসার সময় তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সন্তানের মুখ দেখার সুযোগটুকুও মানুষটির হয়নি। বলেছিলেন একবার দেশে যেতে পারলে আর আসবেননা। জানিনা শেষ অবধি কবে সেই বাবা তাঁর সন্তানকে প্রথম দেখেছিলেন, কোলে নিয়েছিলেন।
কনস্ট্রাকশন শ্রমিকদের অবস্থা অনেক সময়ই দুর্বিসহ। ভারত আর বাংলাদেশের কার্পেন্টার বা প্লামবার হামেশাই এদেশে এসে বোঝেন দেশীয় দালাল যে রেটে কনট্র্যাক্ট করে তাঁকে পাঠিয়েছে, এখানে রেট তার তিনগুণ। নিজের খাওয়া থাকার পর বাড়িতে পাঠানোর মত হাতে কিছুই থাকেনা। এদিকে পাসপোর্ট তো মালিকের কাছে। ফলে সুযোগ পেলেই সে পালায় এবং লোক্যালি কাজ করতে লাগে।
মালিক তার নামে অ্যাবস্কনডিং হিসেবে থানায় ডাইরি করে পাসপোর্টটা থানাতে জমা করে দেয়। পুলিশি তৎপরতায় লোকটা এদেশে অবৈধ বলে চিহ্নিত হয়। তার সিভিল আইডি পাসপোর্ট ব্ল্যাকলিস্টেড হয়, ব্যাঙ্ক একাউন্ট এবং হাসপাতালের ফ্রি চিকিৎসার ইন্সিওরেন্স ক্যানসেল হয়। অনেক সময় এরা ধরা পড়ে ; অনেক সময় পাসপোর্ট পেতে নিজেই সারেন্ডার করে।
তিনদিন হাজতবাসের পর তার দেশের এম্ব্যাসি থেকে পেপার তৈরী করে তাকে প্লেনে চড়িয়ে দেয়। দেশে ফিরে আবার একদিনের হাজতবাস। এরপরও অনেকে কাঁড়ি খানেক খরচ করে পাশের দেশ বা রাজ্য থেকে বেনামে পাসপোর্ট বানিয়ে আবার আসার চেষ্টা করে। কিন্তু আধুনিক বায়োমেট্রিক চেকিংয়ে গরিবের সব টাকাই জলে যায়।
একবার কান্দির একজন প্লেনে আমার পাশে ছিলেন। তখন ভারতে ঢুকতে গেলে প্লেনে বসেই ইমিগ্রেশন ফর্ম ভরতে হত। লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে আমায় অনুরোধ করেছিলেন ওঁর ফর্মটা ভরে দিতে। যখন সই করতে বললাম, উনি বললেন কাউন্টারে টিপসই দেবেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম অক্ষর পরিচয়হীন মানুষটি এই বিদেশে কি করেন ! বললেন ভোরবেলা গাছ থেকে খেজুর পাড়েন আর সারাদিন সেসব প্যাকেটে ভরেন।
জানতে চাইলে বললেন “আল্লার কৃপায়” কুয়েতি মালিক খুব ভালো মানুষ। প্রত্যেক দুবছরে একমাসের জন্য প্রচুর উপহার সামগ্রীসহ এমিরেটসে করে বাড়ি পাঠান। তাছাড়াও পরিবারের যে কোন দরকারে লোকটির কান্দির একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। আজও সেই নিরক্ষর মানুষটির পরিতৃপ্ত গলা আমার কানে বাজে “আমার ছেলেটা ইংরিজি ইস্কুলে পড়ে দিদি” ।
লেখক:
গার্গী চক্রবর্তী (ভারত)
চলবে……